সিরাজের পর বাংলার মসনদে আরোহন করেছিলেন কে? বাংলায় শিল্পশিক্ষার ইতিহাস

Part 3

Free reading Bangla books

সিরাজের পর মিরজাফর নবাব হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের আনুকূল্য লাভ করেন মুর্শিদাবাদ

শৈলীর শিল্পীরা। মীরকাশিমের সময়ে লক্ষৌয়ের আগমন ঘটল মুর্শিদাবাদে, আবার একই সঙ্গে শুরু হল পাশ্চাত্য চিত্ররীতির

মিশ্রণ। এর ফলে তৈরি হল কোম্পানি শৈলী নামে এক নতুন শৈলী।

ইংরেজশাসিত ভারতীয় ভূখণ্ডগুলির মধ্যে কোম্পানি শৈলীর প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তাঞ্জোরে।

এর কিছুকালের মধ্যে, অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে মুর্শিদাবাদে এর প্রকাশ ঘটল। ধীরে ধীরে এই শৈলী ছড়িয়ে পড়ল।

কলকাতা, পাটনা, কটক, ছাপড়া, আরা, বারাণসী ও লক্ষেনৗতে। এরপর উনিশ শতকের গােড়ায় দিল্লি আর আগ্রাতেও এর

প্রসার ঘটল। এইসব ছবিতে ফুটে উঠল এদেশের মানুষের পােশাক, হাটবাজার, যানবাহন, উৎসব এবং মিস্ত্রি, নাপিত, মুচি,

দর্জি প্রমুখ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কথা। কলকাতা ধীরে ধীরে অধিকার করে নিল মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব।

ভারতে ইংরেজদের বিলাসী জীবনযাপনের খবর ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ার পর যেখানকার কিছুশিল্পী রুটিরুজির প্রয়ােজনে

এদেশে এসে পৌঁছলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন প্রতিভাবান ও পেশাদার শিল্পী। টিলি কেটল, উইলিয়াম ড্যানিয়েল,

জর্জ চিনেরি এইসব শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখ্য। এঁরা সবাই তাদের স্বদেশীয় রীতিতে ছবি এঁকেছেন। শুধুমাত্র কলকাতার

ইংরেজরা নন, বাঙালি শিল্পরসিক সমাজেও এঁদের কদর ছিল। উনিশ শতকে পাথুরিয়াঘাটার গােপীমােহন ঠাকুর, বর্ধমানের

মহারাজা, পাইকপাড়ার মহারাজা প্রমুখেরা শিল্পকলা সংগ্রহের রেওয়াজ শুরু করেন। এই ধারা ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করল।

কিন্তু বিলেত থেকে আসা শিল্পীর সংখ্যা নিতান্তই অল্প ছিল বলে কিছু দেশীয় শিল্পী, যারা কিছুকাল ইউরােপীয় শিল্পীদের

সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের ডাক পড়ল এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এ দেশীয় শিল্পী যাদের চেতনা

পরম্পরায় মুঘল অনুচিত্রের স্রোত তখনও বহমান, তারা ইউরােপীয় আঙ্গিকে হাত পাকাতে শুরু করে তাদের ছবিতে

বর্ণসম্পাতের প্রয়াস নিলেন ইউরােপীয় চিত্রকলার আঙ্গিকে এবং তখন সে ছবি পালটে গিয়ে এক মিশ্র আঙ্গিকের চেহারা

নিল। এবং এই মিশ্রণটিই হয়ে উঠল বাংলার কোম্পানি স্কুলের একটি অন্যরকম বৈশিষ্ট্য।

স্থানীয় শিল্পীরা প্রথম দিকে গুয়াশ (gouachs) অথবা অস্বচ্ছ জল রঙে আঁকতেন, পরে তারা স্বচ্ছ জল রঙে ছবি

আঁকতে শুরু করেন। ভারতীয় ছবিতে প্রাথমিকভাবে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করা হত। পরবর্তীকালে ইউরােপীয় রুচি অনুসারে

হালকা নীল, সবুজ বা এই জাতীয় রঙের ব্যবহার শুরু হয়। শক্ত কাঠের ফ্রেম বাদ দিয়ে ইউরােপের সাদা কাগজে ছবি আঁকা

শুরু হয়। শিল্পীরা অনেক সময় অভ্রের পাতের ওপর বা হাতির দাঁতের ওপরও আঁকতেন। সাধারণত দিল্লির শিল্পীরা হাতির

দাঁতের ওপর আর মুর্শিদাবাদের শিল্পীরা অভ্রের পাতের ওপর ছবি আঁকতেন।

কয়েকটি প্যানেলে ক্যানভাসকে ব্যবহার করে পটুয়ারা কোনাে কাহিনি।

ফুটিয়ে তুলতেন। কাহিনিগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল পৌরাণিকঅথবা লােকগাথা

ভিত্তিক। আমাদের দেশে মূলত বেদে সম্প্রদায়ের লােকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে

গানের সুরে এইসব পটের কাহিনি বর্ণনা করতেন। এইসব গানই পটের গান

নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে বাংলার মানুষের

কাছে বিনােদনের অন্যতম উপাদান ছিল এই পটের গান। গায়েনরা গান গাইতেন

চণ্ডীলীলা, রামায়ণ, মহাভারত, মহরম, পদ্মপুরাণ, সত্যপীর, গাজীর পট প্রভৃতি

অবলম্বন করে। রাজস্থানে পটচিত্রের চর্চা থাকলেও বিষয়বৈচিত্র্যে তা বাংলা ও

উড়িষ্যার পটশিল্পের মতাে সমৃদ্ধ ছিল না। পূর্ববঙ্গের গাজীর পট বা সত্যপীরের

পট ছিল অনবদ্য।

উনিশ শতকের বাংলায় প্রসিদ্ধি পেল কালীঘাট পট। প্রাচ্য এবং

Also Read: Elon Musk as Reddit users punish wall street

পাশ্চাত্যের চিত্রশৈলী মিশিয়ে এই পট তৈরি হত এবং এতে প্রধানত হিন্দু দেবদেবী

ছবিই চিত্রিত হত। সমাজের বিভিন্ন বিষয়কে সমালােচনা করে কালীঘাট পটাতে

একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দলিলে পরিণত করতে পেরেছিলেন এই পটশিল্পীরা।

সে সময়ে এই পটশিল্প অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এক আনা মূল্যের বিনিময়ে

মানুষ পটগুলি কেনার জন্য ভীড় জমাত। প্যারিসেও কালীঘাট পট বিক্রি হয়েছিল

এবং প্যারিসে স্বয়ং পিকাসাে এই পট কিনেছিলেন। এই চিত্রশৈলীর প্রভাবও তাঁর

কর্মধারায় লক্ষ করা যায়। বলা হয়, ফার্নান্দ লেজের চিত্রণেও কালীঘাট পটের ছায়

পড়েছিল।‘মােহন্ত ও এলােকেশী’এই পটশিল্পের একটি উল্লেখযােগ্য উদাহরণ।

বাংলায় শিল্পশিক্ষার ইতিহাস :

কলকাতা শহরে ইউরােপীয় রীতির চিত্রকলা চর্চার জন্য উনিশ শতকের মাঝামাঝি
সময় থেকে শুরু হলাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন। ১৮৩৯ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হল
‘মেকানিক্যাল ইন্সটিটিউট'। বিখ্যাত শিল্পী কোল্ডসওয়ার্দি গ্রান্ট এখানে সপ্তাহে দুদিন
নির্মিতিমূলক বুনিয়াদি আঁকা শেখাতেন। অঙ্কন বিদ্যাকে এখানে যাবতীয় শিক্ষার
ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তাই এই বিদ্যালয় ছিল শিল্পকলা শিক্ষার অঙ্কুর
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।

১৮৫১ সালে লন্ডনে ‘গ্রেট এগজিবিশন’-এ প্রদর্শিত ভারতীয় চিত্রকলার নির্দশনগু
ইউরােপীয় শিল্পমহলে সাড়া ফেলায় এদেশের শিক্ষিত মানুষের মনেও আবার শিল্পক
শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এর ফলে ১৮৫৪ সালে ‘সােসাইটি ফর দ্য প্রােমােশন অ
ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ গঠিত হয়। এই সােসাইটিতে ছিলেন হজসন প্রাট, রাজেন্দ্রলাল মিন
প্রমুখ। এই বেসরকারি উদ্যমে কলকাতায় ‘
দিক্যালকাটা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ স্থাপিত
হয়েছিল এই বিদ্যালয়টি ১৮৬৫ সালে সরকার অধিগ্রহণ করেন এবং এর নাম হয় গভর্নমেন্ট
স্কুল অফ আর্ট। হেনরি হােভারলক এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়ােজিত হন। স্বাধীনতার
পর ১৯৫১ সালে এই বিদ্যালয়ের নাম হয় গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট'। এটি
এখন কলকাতায় ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের পাশে অবস্থিত।

এ কথা বলাই যায় যে হেনরি হােভার লক ১৮৬৪ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত আর্ট
স্কুলের পরিচালনায় থেকে বাংলায় আধুনিক শিল্পশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেন। কিছুদিনের
মধ্যেই তার অনেক ছাত্রই পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে দক্ষতা অর্জন করে। তার সুযােগ্য ছাত্রদের
মধ্যে ছিলেন অন্নদাপ্রসাদ বাগচী, শ্যামাচরণ শ্রীমানী প্রমুখ। কলকাতায় প্রথম স্থায়ী আর্ট
গ্যালারির প্রতিষ্ঠাও তারই উদ্যোগে। ১৮৭৬ সালে আর্ট স্কুলের সংলগ্ন বাড়িতে এই আর্ট
গ্যালারিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লকের পরবর্তীকালে আর্ট স্কুলের নাম করা ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য
শশী কুমার হেশ, রােহিণীকান্ত নাগ ও ফণীন্দ্রনাথ বসু। রােহিণীকান্ত ও ফণীন্দ্রনাথ ছিলেন
মূলত ভাস্কর। শশী কুমার হেশের খ্যাতি প্রধানত প্রতিকৃতি আঁকায়। তবে সমসাময়িক বা
তার আগে আরাে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায় যাঁরা প্রতিকৃতি অঙ্কনে যথেষ্ট দক্ষতার
পরিচয় দিয়েছিলেন, যেমন গঙ্গাধর দে, প্রমথনাথ মিত্র, অন্নদাপ্রসাদ বাগচী এবং বামাপদ
বন্দ্যোপাধ্যায়।

0 Response to "সিরাজের পর বাংলার মসনদে আরোহন করেছিলেন কে? বাংলায় শিল্পশিক্ষার ইতিহাস"

Post a Comment